কবিতা গাছের মতো। ফল দেয়। ফুল দেয়। ছায়া দেয়। বৃষ্টি আহ্বান করে অন্তরাত্মাকে স্নিগ্ধ করে। কবিতার শিকড় চলে যায় গভীর থেকে গভীরতর, গভীরতমতে। কবিতা মাটি থেকে রসে টেনে নিয়ে সন্তাপ দেয় বিক্ষুব্ধ হৃদয়কে। নিবিড়তর তিমির কাছে আনে কবিতাই।
ইদানীংকালে ভক্তি শব্দটি সাবধানে উচ্চারণ করতে হয়। যেভাবে ভক্তিবাদকে উগ্রমৌলবাদের সঙ্গে গুলিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে, তাতে ভক্তির নির্যাস নেই।
কবীর স্মরণে আসেন তাই। সন্ত কবীর। ভক্ত কবীর। প্রভুর প্রতি দাস্যে কবীরদাস। পুণ্যভূমি বারাণসী ছেড়ে মগহর নামক অপরিচ্ছন্ন শহরে চলে যাওয়া প্রকৃত সন্ত কবীর।
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের ‘কবীর’, তিনি নিজেই বলেছেন, “লকডাউনের স্বল্প সময় জুড়ে কবীরকে বোঝার চেষ্টা করে গেছি মাত্র, প্রেক্ষাপটে আছে তাঁর লেখাগুলি, অথচ সেই নিরাবলম্ব অবলম্বন, আর্তি, কোনও কিছু সেভাবে এখনও মনের ঘরে জুড়ে বসতে পারেনি…”
এই কাব্যগ্রন্থ পড়ার আগে ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কবি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে তাঁর দোলাচলের কথা ব্যক্ত করেছেন। কবীরকে পড়তে পড়তে নিজস্ব আচ্ছন্নতার কথা বলেছেন, একজন প্রকৃত সন্ত হিসেবে যে কবীর চিরবিদ্রোহী ছিলেন, যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতপাত, গুরুবাদ ভাঙতে চেয়ে ভক্তি আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই কবীরের গান প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, “কবীর অনুবাদ করেছি বটে, কিন্ত সেই আধ্যাত্মিকতা বোঝার সাধ্য আমার নেই।”
এই স্বীকারোক্তি একপ্রকারের নিমগ্নতা। “যেন এক সন্ধ্যাভাষায় নির্মিত দরজা।” এই বাক্যটিকে অনুধাবন করা প্রয়োজন। কবি বলছেন, “সেই দরজা ঠেললে, খুলে যাবে। এবং আরও দরজা পরপর খুলে যাবে। খুলতে খুলতে জীবনের দর্শন হবে। জীবনের মণিমুক্তোগুলি চোখে পড়বে। হয়তো বা।”
অর্থাৎ, সংস্কৃতভাষাকে কুয়োর জল, যা সকলের জন্য নয় বলে বর্জন করে সন্ত কবীর মিশ্র হিন্দিভাষায় তাঁর দোঁহা রচনা করেছিলেন, মানুষের সঙ্গে মিশে যাবার জন্য, সেই ভাষা এবং ভাষার অন্তর্নিহিত মানবতাবাদকে অধ্যয়ন করা এক নিরন্তর মননযাত্রা। ব্যক্তিগত এবং নৈর্ব্যক্তিক। তাই ‘চৈতালীর কবীর’। এই নিছক-তর্জমা-নয় গানগুলিতে আবিষ্কারের প্রার্থনা আছে, অবিশ্বাস থেকে বিশ্বাসে পৌঁছানোর চলমানতা আছে, আর্তি আছে।
কাজল পড়লে চোখে/ ক-জন দেখতে পায় ভালো।/ সে প্রেমিকা সব দেখে/ যার চোখে মোহনের আলো।
নিবেদন এই মতো হয়। সাগরের জলে নুন মিশে গেছে ভিন্ন করা যায় না। দুঃখ সুখ, ভয় আনন্দ, বিরহ মিলন মিলেমিশে একাকার। কখনও একেবারে স্পষ্ট, কখনও রূপকাবিষ্ট ছোট ছোট গানগুলি বড় স্নিগ্ধ। কোথাও অতিরিক্তের রেশমাত্র নেই। এ যেন নন্দলালার মন্দিরে মীরাবাই নাচছেন। ‘মীরা কহে বিনা প্রেমসে প্রেম না মিলল রে।’ মূলকথা, ভেদাভেদ নেই। যত মত, তত পথ। এই বিশ্বজোড়া মানুষ। হাজার লক্ষ আচার। সব গিয়ে মিলেছে প্রেমে। সব পথ শেষে মিলে গেল শেষে তোমারই ও দুটি নয়নে।
নিম গাছেও চন্দনের সুবাস লাগে। পরশপাথরে লোহা সোনা হয়। জল গঙ্গায় মিশে গঙ্গা হয়ে যায়। এই তর্জমাতে যে ভক্তি আছে তা হৃদয়জাত এবং মননজাত।
চৈতালীর কবীরের গানের মর্মমূলে আছে সহজরস। তার অন্ত নাই গো নাই। ঝর্নার মতো স্বচ্ছ ধারায় কবিতা বয়ে গেছে।
নৌকায় ভেসে যেতে যেতে/ মাঝনদীতে কেউ ডুবে
যায়/ নৌকো মিলল না যার/ সে দিব্যি পার হয়ে যায়।
কী গভীর বাণী, কী আশ্বাসের কথা বলেছেন কবি। এরপরে আর কোনও ভয় থাকে না। এই পরম আশ্বাস। আশ্রয়। ভয়ে, বেদনায় দীর্ণ, জীর্ণ মানুষ এর অধিক কী-ই বা চাইতে পারে! কিন্ত সমর্পণ করতে হবে। মন্দিরে ঢুকলে তো ভিজবে, দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকলে শুকনো থেকে যেতে হবে যে!
অহংবোধকে লীন করেছেন বিশ্বাসে।
আমি দ্রাক্ষা/ আমি লেবু।/ মুসলমান/ ও/ হিন্দু।/ আমি মাছ/ আমি জাল/ আমি জেলে।/ আমি/ শুধুই সময়/ আমি কেউ নই/ কবীর বলল,/ আমি নই কেউ/ আদপে।
এই ছন্দবোধে বিস্মিত হতে হয়।
প্রতিটি বাইনারি, ভিন্নতাকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিন্ত শেষের উপলব্ধি সেই অমোঘ সত্য: আমি কেউ নই। সময় সব ঠিক করে দেয়। সময় শেষ কথা। রাজা লিয়র জীবনপ্রান্তে গিয়ে তাই তো বুঝেছিলেন! কেন বৃথা হাহাকার করে মানুষ!
দশানন রাবণ।/ পুত্রকন্যা অগণন।/ সমুদ্র-পাহারঘেরা লঙ্কায় তার/ কেউ রইল না।/ প্রাসাদের এক আধলা ইঁটও থাকল না।
জীবনদর্শন প্রতি পদে—
সঙ্গে আনিনি কিছু/ যাবে না কিছু।
এক আকাশ কামনা বাসনা/ টুকরো টুকরো হয়ে/ভেঙে পড়বে তমসা ভেলায়।
যে কামনাবাসনাকে কেন্দ্র করে লালসা-দগ্ধ মানুষ গোটা পৃথিবীটাকেই জতুগৃহ করে তুলছে, তার কোনও কিছু থাকবে না জেনেও নিরলস ছুটে চলা ইঁদুর দৌড়ে। শরীর আর ভোগসর্বস্ব দুনিয়া তাও শোনে না। কেবল শরীর শরীর করে।
কবীর বলছেন,
শরীর, মাটির পাত্র/ মন তাতে মাঠার মতো…
মাখন তোলার পর,/ পাত্র ভেঙে গেলে পর,/ বলছে কবীর, গোয়ালিনি,/ উল্লসিত হও।
চালাক চতুর লোকে ছেয়ে যাওয়া শহরবাজারে রামের গহনে ঢেলে দেওয়া জীবন শান্তি পায়। মানুষে মানুষে ছয়লাপ চতুর্দিক। কেমন মানুষ তারা? আহা! আগেও ছিল। এখনও আছে। পরেও থাকবে।
একঘটি জল দেবে না কাউকে
গঙ্গা যে নামিয়ে আনা
তারও নিন্দায় মাতবে।
চেনা চেনা মানুষ সব। আর স্বচ্ছ সহজ অনুবাদে প্রাঞ্জল।
একটি আঙুলও কারও জন্য নাড়ে না—
নাড়ে শুধু অন্যকে দোষ দেবে যখন।
অথবা
বৈকুন্ঠে যাই, বলছে যারা,
পাশের গলির কথা জানতে চাও
অমনি চুপচাপ হয়ে গেছে।
এইসব চন্দনগন্ধী কবিতার শ্লেষ কম নয়—
ষাড়ের গর্ভ হয়।
গোরুরা বন্ধ্যা।
বাছুর দুধ দিচ্ছে দিনে তিনবার
আর
ইঁদুর নৌকা বাইছে।
এমন জায়গা, যেখানে,
ব্যাংকে রক্ষা করে সাপ,
শেয়াল খেদিয়ে নিয়ে যায় সিংহকে।
রাজনীতি, সমাজনীতি সবকিছুকেই তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন কবীর আর লিখেছেন কখনও সোজাসুজি, কখনও রূপকে।
লাগাম লাগিয়ে মুখে,/ পিঠে জিন পরাও,/ রেকাবে পা দাও।/ তারপর চলা— মন,/ তারপর পথ, নির্জন,/ সোজা বৈকুন্ঠে গেছে।
বিরূপতা, বিমুখতা, বিরুদ্ধতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এইটুকুই তো করতে পারে মানুষ। প্রতিটি কবিতা বারবার করে পড়তে হবে। একটি অর্থের মধ্যে নিহিত আছে আরেকটি অর্থ। গভীর থেকে আরও গভীরে। সহজের মধ্যেই আছে বহুমাত্রিকতা। সহজ সরল গানে মেতে আছেন কবীর। নিজেই বলেছেন, মর্ম উদ্ধার করো। তবে তো তাকে পাবে। ভজন কীর্তন নয়। দিনযাপন। নিজের যাপনে রাম।
স্রষ্টা যিনি, তিনি কি কপালে/ জাত ও ধর্মের জন্মদাগ/ এঁকে দিয়েছেন।
অতীন্দ্রিয়তা আছে এমন সরলতায়। ভক্তি আন্দোলনের দুই প্রধান অবতার রাম এবং কৃষ্ণ। তামিলনাড়ুতে যে ভক্তি আন্দোলনের জন্ম তা উগ্র ছিল না কখনোই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছেন। দার্শনিকতাকে ধারণ করেছেন গণচরিত্রকে গঠন করতে। সঙ্গী ছিল সঙ্গীত ও সহায়ক বাদ্যযন্ত্র। যখন ধর্মের সন্ত্রাস শুরু হল পঞ্চদশ শতাব্দীতে, কবীর এসেছিলেন মানুষের দর্শন নিয়ে। দক্ষিণ ভারতে যে ভক্তি আন্দোলনের জন্ম, রামানন্দ যে ভক্তিবাদকে নিয়ে এলেন উত্তরে, সাতদ্বীপ ও নবখণ্ডে সেই ভক্তি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন না-হিন্দু, না-মুসলমান কবীর। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গরিমাকে অস্বীকার করে সহজিয়া বাঁশি বাজিয়েছেন যে কবীর, চৈতালী সেই কবীরের সহজ সুরকে তর্জমা করেছেন। সেই জন্য ভক্তিভাবটির মধ্যে তন্ময়তা আছে, আবিষ্ট করে রাখে। সেইটিই ভক্তিবাদের মূল সুর। অহংবোধকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।
আমি বড়ো
আমি বড়ো।
আমি বড়ো।
এই সব বলা কওয়া
বৃথা! আবর্জনা।
পলক ফেলতে না ফেলতে মুছে যাবে এ দুনিয়া যার জন্য যত হিংস্রতা, হানাহানি, ঈর্ষা, দ্বেষ।
প্রকৃতিপূজার কথা এসেছে—
পাতা, ব্রহ্মা,
ফুল, বিষ্ণু।
ফলমূল হল মহাদেব।
এদের এড়িয়ে গিয়ে
তুমি কার পূজায় বসেছ?
এ যেন অন্তরশুদ্ধির মন্তর। কখনও নারীতে রূপান্তরিত। কখনও বলেছেন, “পাষাণমূর্তি পূজা কোরো না”।
পাণ্ডিত্য দেবতাপ্রাপ্তি ঘটাবে না। বলেছেন সন্ত কবীর। তাঁত ভেঙে ফেলে যিনি বুনেছেন সন্তনাম। ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর মন এক তারে বাঁধা। ফাঁদ পাতা এই বিশ্বে কবীরের সাবধানবার্তা বড় মহিমাময়। অথচ কাছের। এইসব কথাকে যেন হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। চোখ দিয়ে দেখা যায়। অমৃতবাণীর ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
শব্দ বাজে জোরে,
পূর্ণ কলসি বাজাও—
কবীর বলছে কান পেতে,
নিঃশব্দের গান শোনো।
পরম শান্তি যেন— নিছক নীরস জ্ঞানের বাণী নয়।
কা তব কান্তা কস্তে পত্নী…
কবীর বলেছেন,
কাকে তুমি পতি বলবে?
কেই বা পত্নী?
কারা মরে যায় আর শোক সন্তাপ করে?
চৈতালীর কবীর একেবারেই চৈতালীর কবীর। অন্ধ বিশ্বাস নয়। অবিশ্বাস নয়। বিশ্বাসের পথে এক অনন্ত যাত্রা। পথের দুধারে প্রলোভন। হরিনাম যে ঐশ্বর্য তাকে পুঁটলিতে বেঁধে রাখা যায় না। পয়সা কামাতে তাকে বিক্রি করা হয় না। বিষয়াসক্তি, ইন্দ্রিয়াসক্তিকে অতিক্রম করে জোড়হাত কবীরের দোঁহার এই তর্জমা একটি বৃক্ষসম।
‘ঢাকা যখন শত্রুপুরী ছিল, তখন একদিন দুই মুক্তিযোদ্ধার হাতে এসে পৌঁছল গোপন কিছু পাণ্ডুলিপি। সেই হলো শামসুর রাহমানের নতুন কবিতা; সৈন্য শাসিত বাংলাদেশের ভিতর থেকে পাঠিয়ে দেওয়া স্বর। …এই পাণ্ডুলিপি এসে আরেকবার আমাদের জানিয়ে দিল, কেমন ছিলেন তাঁরা। অল্প ক’দিন আগে পর্যন্ত সমস্ত বাংলাদেশ ছিল বিশাল এক বন্দীশালা। আর, এই কবিতাগুলি যেন সেই বন্দীশালা থেকে তুলে ধরা স্বাধীনতার নিশান।’
১৯৭২-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত ৩১ পৃষ্ঠার কবিতার বই ‘বন্দী শিবির থেকে’র সূচনা পত্রে প্রকাশকের কয়েক টুকরো কথায় আমরা কবিতার সময়কে ছুঁতে পারছি। এর পঞ্চাশ বছর পরে এসে কৃশকায় বইটি হাতে নিলে কোথাও সেই বারুদ বিস্ফোরণের ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, কোন এক শীতল আস্তানায় বসে কবি লিখছেন, ‘আমি বন্দী নিজ ঘরে। শুধু/ নিজের নিঃশ্বাস শুনি, এত স্তব্ধ ঘর।/ আমরা ক’জন শ্বাসজীবী/ ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। আমি, মানে/ একজন ভয়ার্ত পুরুষ,/ সে অর্থাৎ সন্ত্রস্ত মহিলা/ ওরা, মানে কয়েকটি অতি মৌন বালক-বালিকা—/ আমরা ক’জন/ কবুরে স্তব্ধতা নিয়ে ব’সে আছি। নড়ি না চড়ি না…’ (পথের কুকুর)। এভাবেই কবিতার ধ্বনি ও শব্দের বুননের পথ ধরে আমাদের নিয়ে যায় সেই রণাঙ্গনে। এই ‘বন্দী শিবির থেকে’র কবিতাগুলো ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমবয়সী ও সহমর্মী নিজ-বাসভূমে-পরবাসী এক কবির স্বীকারোক্তিই শুধু নয়,
নিবিড় বেদনায় অলঙ্কৃত সর্বকালীন অনূভূতিমালার শ্রেষ্ঠ সমন্বয়’।
ঢাকা, ১৫ জানুয়ারি ১৯৮৩, দেশ-সীমান্তের খণ্ডিকরণের চিহ্নকে অস্বীকার করে তামাম বাংলার কবিতাপ্রেমিকের কৌম ভালোবাসেন যে কবিকে, তিনি লিখলেন কবিতার অভ্রান্ত ও আবহমান উপমা, “কবিতা লেখার সময়, কোনো এক রহস্যময় কারণে, আমি শুনতে পাই চাবুকের তুখোড় শব্দ, কোনো নারীর আর্তনাদ, একটি মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিমা, কিছু পেয়ারা গাছ, বাগানঘেরা একতলা বাড়ি, একটি মুখচ্ছবি, তুঁত গাছের ডালের কম্পন, ধিকিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি, ঘুমন্ত সহিস ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে বারবার। কিছুতেই এগুলো সরিয়ে দিতে পারি না।” শামসুর রাহমান, বাংলা কবিতার সীমান্ত অস্বীকার করে যিনি লেখেন— “কোথাও হঠাৎ/ দূর দিগন্তের বুক চিরে বাজে স্মরণীয় বাঁশি,/ আসে ব্যোপে কবিতা আমার অলৌকিক বানভাসি।” আমরা অলৌকিক বানভাসি কবিকে ছুঁয়ে থাকতে দেখি কাঁটাতারের এপার ওপার।
বাংলা কবিতার অখণ্ড আকাশের এক প্রধান আলোকশিখা ‘কালের ধুলোয় লেখা’ কবিতার কবি শামসুর রাহমান চিরায়ত বাংলা কবিতার শুধু নয়, প্রতিবাদের ও দ্রোহের বাংলা কবিতারও এক মুখ্য নির্মাতা। বাংলার ১৩৬৬ সনে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় (১৯৬০-এর ফেব্রুয়ারিতে)। এর এক দশক আগে ৫২-র ভাষা আন্দোলন, একটি রাষ্ট্র— জনতার মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনকে কেন্দ্রে রেখে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনছে ক্রমশ। এর দুই দশক আগের দেশভাগের ক্ষত বাংলাভাষীর অন্তরে তখনও কাঁচা, এই সীমান্ত বিভাজনের ক্ষরণ যন্ত্রণা তখনও অনুভূত হয় সংবেদনশীল বাঙালির মানসে। এই যন্ত্রণাকে বুকে নিয়েই শামসুর রাহমান এর বারো বছর পরেও লিখছেন, “ঈষাতুর নই, তবু আমি/ তোমাদের আজ বড়ো ঈর্ষা করি। …বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,/ স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে/ আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।/ …যখন যে-শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,/ কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।/ সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস/ দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের/ অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর/ অথচ এদেশে আমি আজ দমবন্ধ/ এ বন্দী-শিবিরে/ মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ/ মনের মতো শব্দ কোনো।/ …স্বাধীনতা নামক শব্দটি। ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ ক’রে বারবার/ তৃপ্তি পেতে চাই।”
শামসুর রাহমান তাঁর জীবৎকালে দেশের ও বিশ্বের নানা ভাঙাচোরা সময়ের পট পরিবর্তনের সাক্ষী। বাল্যকালে বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা দেখেছেন, দেশভাগ দেখেছেন, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ দেখেছেন, তার বিপর্যয়ও দেখেছেন। এই যে ‘সময়ের বিপুল তরঙ্গের’ স্পর্শ নিয়ে তাঁর বেঁচে থাকা তার ছাপ কবিতায় ধরেছেন, ধরেছেন কি? নাকি ব্যক্তিগত ‘ক্ষোভ দুঃখ ভালোবাসায় কবিতার শ্রীঘরে দিনযাপন করে গিয়েছেন চলে’।
শামসুর রাহমানের কবিতা যাপনের সমসময়েই বাংলা কবিতার আকাশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্য আন্দোলন বা তরঙ্গ হাজির হয়েছিল। এই সময়কালেই বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের ‘কবিতা’ পত্রিকাকে ঘিরে এক নতুন কাব্যভাষার খোঁজে একঝাক তরুণ কবিতা লিখছেন। এর পরপর সুনীল শক্তি বিনয় উৎপল-এর ‘কৃত্তিবাস’-এর উত্থান। শামসুর যখন মধ্যগগনে ভাস্বর তখন এই বাংলায় ‘হাংরি’ আন্দোলন নিয়ে তোলপাড়। এখানে এই কথার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে এই সময় পশ্চিমবাংলায় বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের মাধ্যমে যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে তা প্রকরণগত বিচারে আধুনিকতা, বিষয়বস্তুর বিচারে নয়। এই সময়ের পশ্চিমবাংলার কবিদের এমন কিছু বিষয়বস্তুর কবিতা সেই সময়ের ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ প্রমুখ সংকলনে সঙ্কলিত করা হয়েছিল বা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছিল তেমন বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন, কিন্তু তাঁকে এই নব্য ‘আধুনিকতার তালিকায়’ রাখা হয়নি। বিষয়বস্তুর পরিবর্তনও আধুনিকতার একটি চিহ্ন। ঈশ্বর বা খোদা বিষয়ক চর্চা আনাধুনিক, গজল কীর্তন ভজন অনাধুনিক, বিষয় হিসাবে প্রেমের কবিতা আধুনিক, কিন্তু প্রান্তজনের— শ্রমিক কৃষকের প্রেমগীতিকে আধুনিকতার টিপ পরাতে আপত্তি। বুদ্ধদেবরা এই আধুনিকতাকে একদম কোট-আনকোট মেনে নিয়েছিলেন। পশ্চিমের আধুনিকতা ও সেই আধুনিকতার বিচারে কালচারের নানা ধারণা নিয়েই আমাদের এগোতে হয়, কারণ আমাদের সংস্কৃতি বিচারে আমরা সেই মডেলটাকেই ব্যবহার করি। কালচারের সংজ্ঞা নির্ণয়ে দুটি ধারার কথা বলা হয়, একটি
‘অ্যানথ্রোপলজি’, অন্যটি ‘এলিটিস্ট’। বাংলায় প্রথমটি নৃতাত্ত্বিক বলা হলেও দ্বিতীয়টিকে উচ্চবর্ণ বলতে মন চায় না, আধুনিক উচ্চবর্গীয় নাগরিক সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়। আমাদের বাংলা কবিতা এই উচ্চবর্গীয় স্তরেই আটকে আছে, এখান থেকেই এখনও কবিতার বিচার ‘আবশ্যিক’ বলে মানা হয়ে থাকে। জনতা বা জনচেতনার আংশিক অংশ নিয়েই তার বিস্তার আটকে আছে, এই বন্ধন থেকে বেরোতে চাইছেন কেউ কেউ— তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে অন্যতম সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন বা শামসুর রাহমান অথবা এঁদের অগ্রজ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন সীমান্তের এপারে বসে লেখেন— “আমার ক্ষুধার রাজ্যে যে-কোনো শব্দের মধ্যে/ এখন প্রার্থনা থেকে মন্ত্র/ মন্ত্র থেকে পবিত্র আগুন/ পবিত্র আগুন থেকে মৃত্যু হতে পারি।” (সভা ভেঙে গেলে) তখন শামসুর রাহমান লেখেন— “…শিল্পকর্ম ছিল বলেই ক্ষুধার দাঁতে/ দীর্ণ হয়ে ক্লিন্ন প্রাণে পোড়াই আতশবাজি।/ ঘুমাক তারা ঘুমাক সুখে নিদ্রা এলে রাতে,/ ঝুলিয়ে কাঁধে মরা পাখি আমরা ঘুরতে রাজি।” এটা মানতে হবে যে একজন সৃজনশীল কবির কাছে আপাত সময় ও প্রকৃত সময়ের দ্বন্দ্ব সবসময়েই নান্দনিক সমাধান দাবি করে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিদের কাছেও এই প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক ছিল, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে একাত্তর ছিল না, মুজিব ছিল না, কিন্তু নকশাল বাড়ি ছিল, জরুরি অবস্থা ছিল, গণনাট্য আন্দোলন ছিল। শামসুর রাহমান সেই গুটিকয়েক কবিদের মধ্যে পড়েন, যিনি সীমান্ত অস্বীকার করে দুই বাংলাতেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ওপরের একমাত্র আল মাহমুদ ছাড়া আর কেউ এমনভাবে এপারে সীমান্তবিহীন হয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না, অথচ ছিলেন অনেকেই, যাঁদের কবিতা সম্প্রতি এই বাংলায় পঠিত হচ্ছে আর মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক কারণেই শামসুর রাহমান বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু এপারের বাংলার কবিতা পাঠক তাঁকে বড্ড আপনজন বলে ভেবে এসেছে, আত্মার বড়ো কাছাকাছির কবি হিসাবেই জেনে এসেছে। তাই হয়তো এই বাংলার এবং ওই বাংলার উভয়দিকেরই অনেক প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছেন অখণ্ড বাংলা কবিতা বিশ্বের নাগরিক হিসাবেই, পেয়েছেন আজমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কার, একুশে পদক প্রভৃতি। ১৯৯৬ সালে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট সম্মাননা দেওয়া হয়।
একটি সাক্ষাৎকারে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, “আমি সৃষ্টি করেছি, আমি সৃষ্টি করতে চাই। এটার মধ্যে আমি বেঁচে থাকব কী থাকবো না এধরনের কিছু আমি ভাবি না।” মৃত্যুবোধের এমন স্বকীয় উচ্চতা থেকে তাই তিনি অস্বীকার করতে পারেন যাবতীয় দমনমূলক অনুশাসনকে। তথাকথিত নিরপেক্ষতার ধান্দাবাজির মুখোশটি সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে সযত্নে মুখের উপর সেঁটে নিয়ে অনেকেই উল্লিখিত সেইসব ভয়ংকর সময়গুলোতে মৌনতা অবলম্বন জরুরি মনে করেছেন। কিন্তু জাতীয় ও অন্তর্জাতিক বিপর্যয় সমূহের মুখোমুখি হয়ে শামসুর রাহমানের কলম চুপ থাকেনি। কবিতা নিছক
বিনোদনের বা ব্যক্তিগত শোক-আহ্লাদের উপকরণ হিসাবে ভাবেননি, কবিতাকে ব্যবহার করেছেন রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে— অবশ্যই কবিতার শর্ত মেনে। মুক্ত চিন্তাসম্বন্ধ, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। তাঁর আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’তে আমরা এই বিশ্বজনীন চেতনার স্রষ্টার বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অবস্থানের চিহ্ন ছড়িয়ে থাকতে দেখি।
শামসুর রাহমানের স্মৃতিচারণমূলক গদ্যে মুহম্মদ নুরুল হুদা লিখেছিলেন যে চল্লিশ ও ষাটের দশকের কবিরা তো বটেই, এমনকি তাঁর নিজস্ব দশকের কবিবন্ধুরাও তখন তাঁর প্রবল শৈল্পিক প্রতিপক্ষ। কেউ কেউ তাঁকে মধ্যবিত্ত দ্যোদুল্যমানতার কবি বলে ঘায়েল করতে চাইছেন, কেউ তাঁকে নাগরিক কবি, গ্রিক পুরাণের কবি বলে খণ্ডিত ও নন্দিত অভিধায় অভিষিক্ত করছেন। আর শামসুর রাহমান তাঁর অর্ফিয়ুসপ্রতিম অবয়ব নিয়ে নিত্যরঙিন জামা পরে খ্যাতি-অখ্যাতির বাদানুবাদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ‘নতুন’ ও ‘নিজস্ব’ কবিতা লিখে চলেছেন। তিনি কবিতা থেকে যেমন সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেতেন না, তেমনই নিজেকেও কবিতায় লেপ্টে রাখতেন। এই নিবিঢ় আত্মিক
উচ্চারণ তাঁর শেষদিকের কবিতাতেও দেখতে পাই।
আবহমান বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে মনে হতেই পারে শামসুরের কবিতা ‘কবিতার থেকে বেশি প্রত্যক্ষ উচ্চারণে ভারাক্রান্ত’। কিন্তু যে মানবিক মহিমার উচ্চারণ শামসুর রাহমনের আত্মায় লালিত হয় তা থেকে নিছক কাব্যিক দোহাই দিয়ে বিচ্যুতি তিনি চাননি। কবির তারুণ্যকালে রচিত প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’-তে তাঁর কবিতা দর্শনের ভাষ্যে নির্মিত কবিতায় এই দায়বদ্ধতার প্রকাশ দেখেছিলাম, যা ছিল তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী। শামসুর রাহমান একদিকে যেমন সহজ উচ্চারণের কবি, অন্যদিকে তিনি আবার গভীর অবচেতনেরও কবি। আর এ দুইয়ের মধ্যে তাঁর কবিতার কোনও বিরোধ নেই। সেই অবচেতন দেশ থেকে একটা উদ্দীপক রশ্মি তাঁর সমস্ত কবিতায়, কোথাও স্পষ্টভাবে কোথাও অলক্ষ বাতাসের মতো রয়ে যায়। শামসুর রাহমানের কবিতার যে দিকটি পাঠককে আকৃষ্ট করে তা হল তাঁর উপস্থাপনা কৌশল ও মুন্সিয়ানা। ‘কিছুই নেই’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি,
“কী আছে আমার আজ? এমন কিছুই নেই যার/ হিরন্ময়তায় দেবতার/ দ্যুতি হবে ম্লান আর বিত্তবানগণ/ হবেন আমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ।…”
শামসুর রাহমানের কবিতা প্রসঙ্গে আপাত সময় ও প্রকৃত সময়ের দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে বলা যায় যে বাংলা ভাষার বিস্তৃত ভূগোল যেহেতু বিচিত্র উচ্চাবচতা নিয়ে গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে লক্ষ করা যায় সমাজ-বাস্তবতার ইতিহাস-নির্দিষ্ট ভিন্নতা আর সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও সংবেদনের অসংখ্য স্তরবিন্যাস। একদিকে যখন মহানাগরিক অভিজ্ঞতা চরম বিচ্ছিন্নতাবোধের লালন করছে, তখনই হয়তো অন্যদিকে মাটির গন্ধমাখা উন্মুক্ত প্রান্তরের মুক্তির অনুভব বাংলা কবিতায় নিয়ে আসছে আশ্চর্য এক সজীব প্রতিশ্রুতি। শামসুর রাহমান সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসেন, সীমান্তের অন্যদিকে সেই সুবাতাসের প্রতিশ্রুতি নিয়ে কবিতা লিখে যাচ্ছেন তখন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আলোক সরকার, অমিতাভ দাশগুপ্তরা। নাগরিক বৈদগ্ধ ও মনন যখন প্রকাশরীতির চাতুর্যে দিগভ্রান্তিকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই হয়তো সহজ সুরে নিবিঢ় প্রত্যক্ষতা দিয়ে মানবিক অস্তিত্বের আনন্দ-বেদনাকে কবিতায় সঞ্চারিত করছেন সীমান্তের ওপার এপারের গুটিকয় কবি।
কলকাতা বা ঢাকার মহানাগরিক জীবনে যে শিকড়হীনতা ও যান্ত্রিকতা রয়েছে, পশ্চিমবাংলা বা বাংলাদেশের সমস্ত কবিকেই সেটা স্পর্শ করতে পারে না, পারবে না। সাম্প্রতিক উৎপাদন ব্যবস্থার নিরিখে সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ যে-সমস্ত অঞ্চলে গভীরতর সন্ত্রাসের থাবা বসিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে ক্ষত-লাঞ্ছনার বিভীষিকা ব্যক্তি-সত্তায় যতখানি প্রত্যক্ষ, মাটির ও জনতার নিকটস্থ মানবের আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নের অভিঘাত ধারণ করে থাকা কবিদের কবিতায় তার অনুরণন সেই প্রত্যক্ষতা বিমুক্ত হতে পারে না। সমাজ-পরিবেশের কুশ্রীতা সম্পর্কে শামসুর অবহিত থাকার ফলে লিখতে পারেন, ‘মাতাল প্রৌঢ়রা শরীরী আনন্দের খোঁজে ঢুকে যাচ্ছে যে-যার গণিকার ঘরে’। এই সময় আমরা সীমান্তের এপারে দেখি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখছেন ‘সভ্যতার সব পাপ স্তব্ধ মানচিত্র হয়ে আছে’। সামাজিক নিশিগ্রস্থ সামাজিক আবহের থেকে পালাতে চাননি তিনি বা শামসুর। অলোকরঞ্জন লিখলেন, “যখন দেখি বস্তি-পাড়ায় শিকার-শুয়োর বাঁচিয়ে রেখে/ এক-এক করে শরীরাংশ-মাংস কাটে জল্লাদরা/ আমার শুধু চোখের দেখা, আমার শুধু কান্না-পাওয়া/ হাত-পা বাঁধা এখন আমার আলোয় এবং অন্ধকারে।”
সেই সময় শামসুর রাহমান লিখছেন— “আমি বন্দী নিজ ঘরে শুধু/ নিজের নিঃশ্বাস শুনি, এত স্তব্ধ ঘর।/ আমরা ক’জন শ্বাসজীবী/ ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। আমি, মানে/ একজন ভয়ার্ত পুরুষ,/ সে, অর্থাৎ
সন্ত্রস্ত মহিলা,/ ওরা, মানে কয়েকটি অতি মৌন বালক-বালিকা—/ আমরা ক’জন/ কবুরে স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছি…”
শামসুর রাহমানের মধ্যে দেখা যায় জীবনানন্দের অনুষঙ্গ ছায়া সূচনা পর্বে বিস্তার করে আছে। ক্রমশ শামসুর রাহমান নিজের ‘সিগনেচার’ খুঁজে নেন। সমসময় পরিধির মধ্যে বৌদ্ধকতার সীমাবদ্ধতা থেকেও তিনি সূক্ষ্ম সংবেদনময় ভাষায় ব্যক্ত করতে চেয়েছেন শামসুরিয় অভিঘাত। এই সময় ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতাবাদের কালো ছায়াকে তিনি পেরিয়ে যান। সীমান্তের এপারে তখন অজস্র স্বপ্নভঙ্গ ও দহনজ্বালার বোধ শিকড়হীন অবস্থাজনিত টানাপোড়েনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাস্তিগর্ভ নাগরিকতার তিক্তকষায় উপলব্ধি নিরঙ্কুশ হয়ে উঠছে।
“স্বাধীনতার পরবর্তী এক দশক স্বপ্নময় তন্দ্রা অবসান ও রূঢ় আঘাতে সচেতন হয়ে ওঠার যুগ। ‘জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম ভার’ যাঁদের সইতে হয়েছিল, তাঁদের কাছে ক্রমশ সমস্তই প্রতিভাত হলো পান্থপাদপশূন্য মরুপথ কিংবা দীর্ঘায়ত চোরাবালি হিসাবে।” (ড. তপোধীর ভট্টাচার্য/ প্রসঙ্গ পঞ্চাশের কবিতা)।
১৯৪৭-এর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই বাংলার মানুষের সামনে দেশভাগ, উদ্বাস্তু শিবিরের কান্না, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মূল্যবোধের সামগ্রিক বিপর্যয়ের ভাঙনমুখর সময়ের অভিজ্ঞতা জমে ছিল। কবিতায়, নাটকে, আখ্যানে সেই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা গেছে। পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শক্তির হাতে দেশের চালনা শক্তি হস্তান্তরিত করে দেয় শ্রেণিমিত্র ঔপনিবেশিক শক্তি। দ্বিজাতিতত্ত্বের তরবারিতে দ্বিখণ্ডিত বাঙালির উত্তরাধিকার। আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলার আবহমান সংস্কৃতি-চেতনাকে আবিল করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় প্রতিমূল্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। এই সময় পণ্যায়ন-প্রবণতা জোরালো হয়ে নান্দনিক চেতনাকে অন্তর্ঘাত করেছে ক্রমাগত। শিকড়হীন উদ্ভট সাহিত্য আন্দোলনের নামে এলোমেলো করে দেওয়ার কূটকৌশল, সাহিত্যর নতুন চর্চার নামে এঁরা সমাজ-বিপ্রতীপ সাহিত্যের মাঠে নেমে পড়লেন। ব্যক্তিসর্বস্বতার ছোট জগতের অবরোহী আধুনিকতা সভ্যতার ইতিহাসের চাকাকে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইল। এই ঋণাত্মক আবহ থেকে স্বতন্ত্র থেকেই কেউ কেউ কবিতায় মানবিক আবেদনের বার্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, সমর সেন থেকে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের মতো কবিরা। সীমন্তের ওপারে তখন নয়াযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে, বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধিকার রক্ষার লড়াই। যে লড়াইয়ে যুক্ত হল কবিতা, সাহিত্য, থিয়েটার। শামসুর রাহমানের মতো কবিরা সেই যুদ্ধের ভাষা-সেনানী হয়ে উঠলেন। এপারে যখন কবিতায় আত্মঘাতী ক্রোধ ও বেপরোয়া ঔদ্ধত্য জাঁকিয়ে বসল, জীবন ও সমাজের ব্যাপক অনেকান্ত আলো-হাওয়া-রৌদ্রের পরিসর ছেড়ে কবিরা ক্রমশ বেছে নিলেন চোরাবালি ও শশ্মানিক নৈঃশব্দ্য। তাঁদের আত্মরতি সমর্থন খুঁজল প্রতীচ্যের কবিদের অভিজ্ঞতায়। সামাজিক সংকটের থেকে মুখ ফিরিয়ে, আত্মবিনাশী তাড়নায় তাঁরা প্রতিষ্ঠানেরই, শোষক শ্রেণিরই স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছেন— মার্কিনি লাম্পট্যের ভুয়ো মূল্যবোধের আফিম খাইয়ে তাদের সুরে গলা মিশিয়েছেন। কিন্তু এই দূষণের বিপ্রতীপে থেকেও কবিতায় জীবনের বার্তা দিয়ে চলেছেন কেউ কেউ, উদাহরণ হিসাবে শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষদের থেকে কিছুটা অনুজ রামেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর কবিতা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যায়, “হয়তো গন্তব্য ছিল সূর্যালোক কিংবা আরো দূর গ্রহান্তরে/ ডেকে নিয়ে এলো তাকে আমাদের বিষণ্ণ পল্লব,/ ভাবে নাই, অনভিজ্ঞ, এখানে ঝরণার কণ্ঠস্বরে/ গরল লুকিয়ে থাকে, নরক ছাড়ায় তিক্ত ফুলের সৌরভ।” এদেরই অন্যতম অগ্রজ শামসুর রাহমান।
সীমান্তের এপার-ওপারের বাংলায় সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়টা চূড়ান্ত আশাভঙ্গের ও স্বপ্নবিনাশের যুগ। ওই সময় যাঁদের কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে— দেশবিভাগ ও উদ্বাস্তু জীবনের অভিশপ্ত যন্ত্রণা তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অংশের কবি-সাহিত্যিকরা পরিবর্তিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে কোনও নতুন আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌলিক চিন্তার সূত্রপাত করতে পারেননি। “নিজেদের বাস্তব স্বার্থ ও সামাজিক অবস্থানের ফলে এই প্রজন্মের তরুণ বুদ্ধিজীবীরা প্রাত্যহিক জীবনে নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করতে পারেননি বলে তাঁদের মানসিক জগতেও সেই সুনির্দিষ্ট সীমান্ত অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছিল। তাঁদের নিরালম্ব অবস্থান যে দেশ-বিভাজন পরবর্তী আর্থসামাজিক প্রক্ষিতের অনিবার্য পরিণাম— সেইটে বিবেচনা না করে তাঁরা বুঁদ হয়ে রইলেন আত্মসর্বস্বতায়।” (ড. তপোধীর ভট্টাচার্য/ কবিতার রূপান্তর)। পঞ্চাশের বা তৎপরবর্তীকালের কবিরা জীবনবাস্তবতা চ্যুত রোমান্টিক বিষাদের সঙ্গে নাগরিক জীবনের চমক সর্বস্বতা জুড়ে দিয়ে ভাষামুক্তির খোঁজে পথে নামলেন। বিষ্ণু দে, সমর সেন বা মঙ্গলাচরণ প্রমুখদের মধ্যে যে আদর্শবোধ আমরা লক্ষ করি, ১৯৪৭-এর পর সেই আদর্শবোধ উবে যেতে দেখি নতুন কলমে। গুরুতর ঐতিহাসিক কারণেই এঁরা হয়ে উঠলেন সুবিধাবাদী ও ভঙ্গি সর্বস্ব। তবুও এটাও সত্য যে আঙ্গিক চেতনার প্রাবল্য সেই সময় বাংলা কবিতার ভাষাকে অনেকখানি এগিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল কেননা খণ্ডিত, সীমাবদ্ধ বা একদেশদর্শী হলেও তাঁদের ভাষায় ‘নতুন সময়ের নতুন চেতনা’র ছায়াপাত করেছিল। কবিও একজন সামাজিক মানুষ, সামাজিক মানুষের মতো তাঁরও ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তিবোধ রয়ে যায়। কবিতায় তা ফুটে ওঠে অনেক সময়। এপারে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন, লেখেন— “সুখ দুঃখ কিছু নেই— এমন পাথর হয়ে গেছি/ মানুষের ব্যবহারে হয়েছি পাথর ক্রমাগত/ গাছে বজ্রপাত নিয়ে, পাথর প্রতিমা/ তাকে সঙ্গে, বুকে নিয়ে, পাথর হয়েছি অহংকারে!” (কল্যাণীয়া)
শামসুর লেখেন— “…কবিকে দিও না দুঃখ, স্বপ্নের আড়ালে তাকে তীব্র/ আবৃত্তি করতে দাও পাথর, পাখির বুক, গাছ/ রমণীয় চোখ/ ত্বক, হেঁটে যেতে দাও ছায়াচ্ছন্ন পথে, দাও সাঁতার কাটতে/ বায়ুস্তরে একা,/ অথবা থাকতে দাও ভিড়ে নিজের ভেতরে। রোজ/ হোক সে রূপান্তরিত বার বার। নিজস্ব জীবন রেখেছে সে/ গচ্ছিত সবার কাছে নানান ধরনে অকপট।/ কবিকে দিও না দুঃখ, একান্ত আপন দুঃখ তাকে/ খুঁজে নিতে দাও।” এমন করেই কবিতার গলিঘুঁজি ধরেই ব্যক্তিগত উচ্চারণের উত্তরণ ঘটে সমষ্টির কবিতায়।
এরই মধ্যে এসে যায় দেশকালের আয়তন। সমকালের গভীর রিক্ততা পঞ্চাশের বাংলার কবিদের কিছু অংশকে ভাবিয়েছে। সময়ের গভীর নিহিত যন্ত্রণা ও আত্মলোপ অনুভব করে নিজস্ব চেতনার ভাষায় তা কবিতার উচ্চারণে ব্যক্ত করেছেন। তাই আমার মনে হয় যে সেই যুগসন্ধিক্ষণে লিখতে এসেছিলেন যাঁরা এমন কেউ যদি নিছক অভ্যাসের বশে নিজের মুদ্রাদোষকে নিজেই অনুকরণ না করে বিবর্তনশীল সময়-স্বভাবের আধেয়কে কবিতায় প্রতিফলিত করেন, তাহলে সেই কবিকে আজকের কবি বলেই বিবেচনা করতে হবে। শামসুর রাহমান এমনিই একজন যুগন্ধর কবি, সমর অতিক্রান্ত কবি, তাই মুগ্ধ হয়ে আজকের পাঠক পড়েন তাঁর ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’-এর মতো কবিতা—
…ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথ যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।
কোথায় পাগলাঘন্টি বাজে
ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা
ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে
এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।
দশদিকে কত একাডেমীতে নিশীথে
গোর-খোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলি
অতিদ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জির মুখ।
কবিতা এখানে সীমান্ত অস্বীকার করে উভয় প্রান্তেরই সময় চিহ্নায়ক হয়ে ওঠে। এখানেই অনেককে পিছু ফেলে এগিয়ে থাকেন শামসুর রাহমান। সমসময়কে সমকালীনতায় আচ্ছন্ন করে, সমকালীন প্রতিটি কালক্রমের সঙ্গে এভাবেই একজন সমাজসচেতন স্রষ্টা নিজেকে মিশিয়ে দেন, তাঁর সৃজন সেই চিহ্ন বহন করে কাল-উত্তীর্ণ হয়। ‘বন্দি শিবির থেকে’ কবিতার বইটি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের অন্তর্ভেদী আবলোকন। শামসুর রাহমানের এই একটি কৃশকায় বইয়ের কবিতাগুচ্ছ পাঠের মধ্য দিয়েই পাঠক পৌঁছে যান সেই রণাঙ্গনে। যে যুদ্ধে পারিপার্শ্বিকতাও জড়িয়ে যায়, এক অপরূপ মানচিত্রের আকাঙ্ক্ষার ভাষা শরীর পেয়ে যায়। “না, আমি যাবো না/ অন্য কোনোখানে।/ আমিও নিজেকে ভালোবাসি/ আর দশজনের মতন। সকালের টাটকা মাখন রোদে জেগে ওঠা, প্রাতরাশ সেরে/ তুমুল আড্ডায় মাতা, চেনা রাস্তা দিয়ে/ হেঁটে যাওয়া, রাত্রি জেগে বই পড়া, আলাপ জমানো/ বন্ধুদের সাথ/ আমারও অত্যন্ত ভালো লাগে… তবু আমি যাবো না কখনো/ অন্য কোনোখানে।/ থাকবো তাদের সঙ্গে এখানেই, বাজেয়াপ্ত হয়েছে যাদের/ দিনরাত্রি, যন্ত্রণায় বিদ্ধ হ’য়ে সকল সময় সারিবদ্ধ/ মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা যাদের নিয়তি।” (না, আমি যাবো না)
‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতার বইয়ের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় ও উদ্দীপক কবিতা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত হয়েছে। “স্বাধীনতা তুমি/ রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/ স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা—/ স্বাধীনতা তুমি/ শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা/ স্বাধীনতা তুমি/ পতাকা শোভিত শ্লোগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।”
এমন একটি কবিতার জন্ম দিলেন কবি যে কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে যে-কোনো যুবক-যুবতি মধ্যবয়সের মানব-মানবীর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়, বুকের কোথাও স্বাধীনতার তেজ জ্বলে ওঠে।
ক্লিন্টন সিলি এবং জীবনানন্দ এই দুই নাম যেন বাঙালির মনে অবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। যদিও ক্লিন্টন সিলি কেবল জীবনানন্দ চর্চাই করেছেন তা নয়। তাঁর অন্য একটি প্রবন্ধের বইয়ের নাম ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড: এসেজ অন বাংলা লিটারেচার’ (ক্রনিকল বুকস, নিউ দিল্লি, ২০০৮)। সেই বইটিতে দেখি, তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন অন্নদামঙ্গল কাব্য নিয়ে; মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে কেন্দ্র করে লিখেছেন চারটি প্রবন্ধ; লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় মঙ্গলকাব্যের দোষ-গুণ নিয়ে। সেই সঙ্গে মীর মশাররফ হোসেন, সত্যজিৎ রায়ের রবীন্দ্র অনুসরণ নিয়ে এবং আরও কিছু বাংলা সাহিত্য বিষয়ক প্রসঙ্গ নিয়ে; তা সত্ত্বেও বলা যায় তাঁর জীবনানন্দ চর্চাই তাঁকে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। আরও একটি সত্য এই যে জীবনানন্দের সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ। যে বইটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই সেটি হল তাঁর সাম্প্রতিক একটি কাজ— জীবনানন্দের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ-সংকলন।
আমেরিকার গবেষক ক্লিন্টন বি সিলি (জন্ম ১৯৪১) ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক হবার পর যোগ দিলেন ‘ইউএস পিস কর্পস’-এ এবং কাজ করতে এলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। সেখানেই শিক্ষকতা করলেন। বাংলা শিখলেন। তখনও জীবনানন্দকে তিনি জানতেন না। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে অধ্যাপক এডওয়ার্ড সি ডিমকের কাছে কাজ করলেন এবং স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জন করলেন ১৯৬৮-তে। অধ্যাপক ডিমক ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ, বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী। সেখানেই আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক লেখক কর্মশালায় জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁকে জীবনানন্দের কথা বলেন। সিলি এরপর কলকাতায় ফিরলেন ১৯৬৯-এ এবং মগ্ন হয়ে গেলেন জীবনানন্দে। জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লিখিত তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ১৯৭৬-এ সম্পূর্ণ হল। তার আগেই ১৯৭১-এ তিনি অবশ্য ফিরে গেছেন শিকাগোতে। এই গবেষণাগ্রন্থ ‘আ পোয়েট আপার্ট’ নামে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯০-এ। বাংলা সাহিত্যে এই অনুরাগী গবেষক অধ্যাপক অতঃপর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ডিমক অবসর গ্রহণের পর সেই পদে যোগ দিয়েছিলেন। এখন তিনিও অবসরপ্রাপ্ত। তাঁর গবেষণাগ্রন্থটি ‘অনন্য জীবনানন্দ’ নামে অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের ফারুক মঈনউদ্দীন। ক্লিন্টন সিলির জীবনানন্দ অনুবাদের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে নেওয়া যায় যে, তিনি বাংলা সাহিত্যের আরও কিছু নিদর্শনের অনুবাদ করেছেন। যেমন বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাস (রেন থ্রু দ্য নাইট, ১৯৭৩); নির্বাচিত শাক্ত পদাবলি (গ্রেস অ্যান্ড মার্সি ইন হার ওয়াইল্ড হেয়ার, ১৯৮২); রামপ্রসাদ সেনের গানের অনুবাদ ও ভূমিকা (১৯৯৯) এবং ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র অনুবাদ (দ্য স্লেইং অব মেঘনাদ, ২০০৪)।
জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর গবেষণার কাজ করবার সময়ই। কবির জীবনকে তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবার প্রয়াস ছিল প্রথম থেকেই। তারপর জীবনানন্দের পঁয়ত্রিশটি কবিতা নিয়ে স্বতন্ত্র একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হল ২০১৯-এ। এই বইটি সামনে রেখে মনে এল অনুবাদ সম্পর্কে কিছু ভাবনা, জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে কিছু ভাবনা এবং ক্লিন্টন সিলির জীবনানন্দ-অনুবাদ সম্পর্কে কিছু ভাবনা।
জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে কাজ নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন মার্টিন কার্কম্যান নামের এক ইংরেজ যুবক। তিনি ভালোবাসতেন আধুনিক কবিতা এবং অচিরেই তিনি বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি কবিদের। কার্কম্যানের সঙ্গে একত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যে অনুবাদ সংকলনের পরিকল্পনা করেন সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালে ‘মডার্ন বেঙ্গলি পোয়েমস্’ নামে এবং তার সম্পাদক ছিলেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। অধিকাংশ কবিতাই অনুবাদ করেছিলেন মার্টিন কার্কম্যান। কার্কম্যান অনুবাদ করবার আগেই জীবনানন্দ নিজের কিছু কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে, বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে। সেগুলির মধ্যে ছিল বনলতা সেন, বিড়াল ও মনোবীজ। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি আরও আটটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কিন্তু সেগুলি দেবীপ্রসাদ সম্পাদিত পূর্বোক্ত সংকলনটিতে নেই। বস্তুত জীবনানন্দের নিজের করা অনুবাদ তাঁর জীবৎকালে একটিই মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘কবিতা’ পত্রিকার একটি বিশেষ দ্বিভাষিক সংকলনে। তারপরে বিভিন্ন জায়গায় জীবনানন্দের নিজের কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য বর্তমান প্রাবন্ধিকের লেখা ‘জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ’ (জীবনানন্দ সমাজ ও সমকাল গ্রন্থ দ্রষ্টব্য; সাহিত্যলোক, সংস্করণ ২০১৬)।
অন্যের কলমে জীবনানন্দের অনেক অনুবাদ হয়েছে তারপর থেকে। বিস্তৃত তথ্যের জন্য জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ প্রবন্ধটি দেখা যেতে পারে। কয়েকজন অনুবাদক হলেন বুদ্ধদেব বসু, লীলা রায়, পি. লাল ও শ্যামশ্রী দেবী, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, ম্যারিয়ান ম্যাডার্ন, শিবনারায়ণ রায়, আনন্দ লাল, জো উইন্টার। তার পরেও করেছেন এবং করে চলেছেন আরও অনেকেই। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সুকান্ত চৌধুরী সম্পাদিত ‘আ সার্টেন সেন্স’ নামের একটি সংকলন, যেখানে সবসুদ্ধ আমরা ষাটটি কবিতা পাই, অনুবাদ করেছেন অনেকেই— শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী, সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, ভাস্বতী চক্রবর্তী, সুকান্ত চৌধুরী, সুপ্রিয়া চৌধুরী, শিশিরকুমার দাশ, ইন্দ্রাণী হালদার, আনন্দ লাল, স্বপন মজুমদার, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার।
ক্লিন্টন সিলির অনুবাদ-সংকলনটি আমরা এখন দেখব। আগেই বলেছি, আমাদের হাতের বইটিতে আছে পঁয়ত্রিশটি কবিতা। সিলি দীর্ঘকাল ধরে জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ করে চলেছেন। এই সংকলনে পূর্বকৃত অনুবাদ যেমন, তেমনই আছে নতুন করা কিছু লেখা। কোনও কোনও কবিতা আবার আগের করা অনুবাদ থেকে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। এ বিষয়ে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির তৃতীয় স্তবকের ‘সব পাখি ঘরে আসে,— সব নদী— ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’— এই পঙ্ক্তিটির অনুবাদ পাঠ করতে গেলে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। সেই আশ্চর্য পঙ্ক্তি— ‘সব পাখি ঘরে আসে,— সব নদী— ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’— সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছে কবির নিজের অনুবাদে। এই পঙ্ক্তির দুটি ড্যাশ— বিশেষত, দ্বিতীয় ড্যাশটি নিয়ে কতই না জল্পনা অনুবাদকদের। মার্টিন কার্কম্যান লিখলেন— ‘…all the rivers flow home…’; আবার ১৯৭২-এ সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত জীবনানন্দের জীবনীতে চিদানন্দ দাশগুপ্ত লিখলেন— ‘…every river reached the ocean’। দুই অনুবাদকই ড্যাশকে কেন ড্যাশই রাখলেন না— এ প্রশ্ন করতেই পারি। তবু এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ড্যাশটিকে উপেক্ষা করেননি তাঁরা। নিজেদের মতো ব্যাখ্যায় ভরিয়ে দিয়েছেন ড্যাশ-এর বাঙ্ময় নীরবতা।
এই কবিতার অনুবাদে সিলির পঙ্ক্তিটি দেখি— ‘All birds come home, all rivers, all of life’s tasks finished.’। এখানে আবার সিলি ভাষা রেখেছেন যথাযথ, কিন্তু ড্যাশ তুলে দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন কমা। সুকান্ত চৌধুরী আবার একটি ড্যাশ রেখেছেন, একটি তুলে দিয়েছেন— ‘All the birds come home, all the rivers— all life’s trade ends.’। ড্যাশ নিয়ে এত বিচিত্র ভাবনা অনুবাদকদের, আমাদেরও একটু ভাবনায় ফেলে দেয়।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি সম্পর্কে দীর্ঘকালের চিন্তায় একটি সিদ্ধান্তে এসেছেন ক্লিন্টন বি. সিলি। তিনি তাঁর ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’ নামক জীবনানন্দের জীবনী-গ্রন্থে এই কবিতাটির ‘মালয় সাগরে’-কে ‘to ‘Malayan seas’ করেছিলেন। সব অনুবাদকই মোটের ওপর এমনই করেছেন। কিন্তু পরে সিলির মনে হয়েছে— এই মালয় ভারত-বহির্ভূত ‘মালয়’ নয়। ভারতেরই মালাবার উপকূল— যেখানে মলয়ালিরা বাস করেন, আছে মলয় পর্বত— তার কথাই বলেছেন জীবনানন্দ। এ বিষয়ে সিলি একটি সম্পূর্ণ প্রবন্ধই লিখেছেন— ‘Shifting seas and Banalata Sen’ (Barishal and Beyond, essays on Bangla literature, D. C. Publishers, New Delhi, 2008)। এই প্রবন্ধে সিলি কবিতাটির অনুবাদে রেখেছেন তাঁর পরিবর্তিত পঙ্ক্তিটি— ‘I have been roaming… to seas up the Malabar Coast.’। কিন্তু কোনও অজানা কারণে সিলি ‘পরবাস’ থেকে প্রকাশিত সংকলনটি আরও পরে, ২০১৯-এ হলেও সেখানে আগের করা পঙ্ক্তিটিই রেখেছেন— ‘I roamed…from waters round Sri Lanka in dead of night to Malayan seas.’। বস্তুতই কোন অনুবাদকের মনে কখন কী চিন্তা জাগে তা পাঠকের পক্ষে বোঝা মুশকিল। আমার অনেক সময়েই মনে হয়, প্রতিটি অনুবাদ-কবিতাই এক একটি স্বতন্ত্র কবিতা।
‘দ্য সেন্ট অব সানলাইট’— জীবনানন্দের কবিতার এই অনুবাদ সংকলনটি হাতে নিলে খুবই ভালো লাগে। প্রতিটি অনুবাদের সঙ্গে মূল বাংলা দেওয়া আছে। সেই সঙ্গে বইয়ের শেষে দেওয়া আছে প্রয়োজনীয় টীকা। ক্লিন্টন সিলির প্রতি এবং পরবাস প্রকাশনা সংস্থার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা রইল। বিশেষ করে সিলির অনুবাদগুলির পাশে অন্য আরও কয়েকটি অনুবাদ রেখে পড়লে পাঠকের মনে অনেক নতুন ভাবনার তরঙ্গ জাগবে। তবে মূল বাংলা পড়তে পারেন বলে এই সুযোগ বিশেষ করে বাঙালিরাই পেতে পারেন। অন্য ভাষাভাষীদের সেই সুবিধা হবে না। তবে এমন হতে পারে, তিন-চারটি অনুবাদ পড়বার পর তাঁদের জানতে ইচ্ছা হবে মূল বাংলা কবিতার পঙ্ক্তিগুলি। এভাবেও বাংলা ভাষা প্রসারিত হয় অন্য ভাষার পাঠকদের কাছে।
নিবন্ধটি কবিসম্মেলন পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত। সংখ্যাটি পাওয়া যাচ্ছে এখানে।
Leave a Reply