আমি পরিষ্কার ও খোলাখুলি বলি— সুকীর্থারানি // কিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়

Home / প্রিয় কবি / আমি পরিষ্কার ও খোলাখুলি বলি— সুকীর্থারানি // কিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়
সুকীর্থারানি

২০২১ সালের আগস্টে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পঞ্চম সেমেস্টারের সিলেবাস থেকে সুকীর্থারানির দুটি কবিতা ও বামা ফস্টিনা সুসাইরাজের উপন্যাসের কিছু অংশ (যা পাঠ্য ছিল) বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। বাদ দেওয়া হয় সাঁওতাল উপজাতির দ্রৌপদী মেঝেনকে নিয়ে মহাশ্বেতাদেবীর বিখ্যাত গল্প ‘দ্রৌপদী’। এবং তা আ্যকাডেমিক কাউন্সিলের পনেরোজন সদস্যের আপত্তি উপেক্ষা করেই। উপরোক্ত দুজন অর্থাৎ সুকীর্থারানি ও বামা ফস্টিনা সুসাইরাজ হলেন দলিত তামিল নারীবাদী কবি, লেখক ও সক্রিয় সমাজকর্মী। তার বদলে উচ্চবংশীয়া পণ্ডিতা রমাবাঈ এবং বেগম সাখাওয়াত হোসেনের লেখা রাখা হয়। এর মধ্যে লেখক হিসেবে সুকীর্থারানি তুলনায় নতুন ও বয়কনিষ্ঠ। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই (জন্ম ১৯৭২) হলেও বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী লেখনীর গুণে এই দলিত তামিল কবি খুব দ্রুত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে এঁর কবিতা স্থান করে নেয়। এর পরেই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে এঁর কবিতার এমন কী নূতনত্ব ও বৈশিষ্ট্য আছে, যা এঁকে অন্য দলিত তামিল মহিলা কবিদের থেকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে? এঁর কবিতাদুটি এমন কী কথা বলে যার জন্যে সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দিতে হয়? অন্য বিখ্যাত দলিত মহিলা তামিল কবিদের মধ্যে সুপরিচিত হলেন মালাথি মৈথ্রি, সালমা, কুট্টি রেভাথি, লক্ষ্মী হমস্ট্রম, ও মীনা কান্ডাস্বামী।
সুকীর্থারানি জন্মগ্রহণ করেন ভেলোর জেলার রানিপেট গ্রামের কাছে লালাপেট নামে একটি গ্রামে। এখনও তিনি ওখানে থাকেন এবং শিক্ষকতা করেন। দলিত তামিল লেখক ঊর্মিলা পাওয়ার, বামা ফস্টিনা সুসাইরাজ ইত্যাদির আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, গ্রামে দলিতদের বাধ্য করা হয় গ্রামের একেবারে প্রান্তের কোনো জায়গায় বাস করতে। যদিও ঊর্মিলা পাওয়ারের আত্মজীবনী ‘আয়াদান’ থেকে জানা যায় তাঁর গ্রামে দলিতরা থাকত গ্রামের একেবারে মাঝখানে একটা আলাদা করা নির্দিষ্ট জায়গায়। সেরকমই সুকীর্থারানির গ্রামের প্রান্তে যে দশ-বারো ঘর দলিত আছেন, তাঁদের জন্যে নির্ধারিত রাস্তা ‘চেরি’তে বাস করা পরিবারগুলির মধ্যে তাঁদের পরিবার অন্যতম ছিল। পুরুষানুক্রমে এঁদের জীবিকা ছিল উচ্চবংশীয় পরিবারের মৃত পশুদের মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে ছাল চামড়া আলাদা করে হয় কবর দেওয়া নয়তো পুড়িয়ে দেওয়া। তার পরিবর্তে এঁরা পেতেন কিছু পরিমাণ শস্য। জীবনের এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর কবিতার পরতে পরতে। দেখে নেওয়া যাক তার কয়েকটি নমুনা।

আমার গ্রামের ছবি
(Portrait of My Village)

কেমন করে দেখে সহ্য করি
আমার শুখা জমিগুলো, যার চারপাশে
শুধু পাহাড় আর টিলা
যেন এক ভূমিকম্পের ক্ষতের মতো।
ঘন টক গন্ধে গেঁজে ওঠা কাঞ্জি;
ঘাস কাটা ও আঁটি বাঁধার মজুরি—
দুহাত জোড় করে গ্রহণ করি যে হাতের পাতায়
তা উলুন্দু তুলে ক্ষতবিক্ষত।
সারা শরীরে নালীবিহীন গ্রন্থির মতো ব্যাপ্ত হয়ে আছে।

যখন কিছু পরিমাণ ধান আমাদের দিকে
ছুড়ে দেওয়া হয় তাদের মৃত পশুদের
বহন করে নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়ার জন্যে
আর সেগুলো বেশিটাই তুষ, তখন—
যন্ত্রণাদায়ক ক্ষিদে সহ্য করার কথা
এখনও স্মৃতিতে টাটকা হয়ে আছে।

অচ্ছুত দূরত্বে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার সময়
আমাদের খালি পা ভিজে যায় চলকে পড়া চায়ে;
জাতপাতের যন্ত্রণায় যখন তা
ঠোঁট থেকে চলকে পড়ে
তালপাতার কাপ থেকে।
আমাদের গ্রামের ছবি সতত দৃশ্যমান
এমন এক ফ্রেমের মধ্যে
যেখানে—
একটি দ্বৈতসত্তার অস্তিত্ব বিদ্যমান।।

কিংবা এই কবিতাটিকে দেখা যাক—

আমি খোলাখুলি কথা বলি
(I Speak Up Bluntly)

যখন মৃত গরুদের ছাল ছাড়ানো হয়
আমি কাকগুলোকে তাড়াতে থাকি।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি, অপেক্ষা করি।
শহরের পরিত্যক্ত বস্তুই হল আমার জীবনধারণ
তাই গর্ব করি সদ্য রান্না করা টাটকা গরম ভাত
খেতে পাওয়ার জন্যে।
যখন রাস্তায় আমি আমার বাবাকে দেখি
তার গলায় একটি চামড়ার ড্রাম ঝুলছে
আমি আমার মুখ ঘুরিয়ে নিই
দ্রুত তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাই
কারণ আমি আমার বাবার পেশা,
তার আয়ের উৎস প্রকাশ করতে চাই না।
স্কুলে শিক্ষক আমাকে বেতের আঘাত দেন
আর বন্ধুহীন আমি শেষ বেঞ্চে বসে
একা একা কাঁদি। কেউ জানতেও পারে না।

কিন্তু এখন—
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে
আমি পরিষ্কার ও খোলাখুলি বলি
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি চাঁড়াল, আমি চামারদের মেয়ে।

প্রসঙ্গত বলি, স্কুলে যাওয়ার সময় থেকে সুকীর্থারানি জাতি বিভেদ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। স্কুলের অন্য ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে মিশত না। শিক্ষকরাও তথৈবচ। যথেষ্ট বইপত্র খাতা ইত্যাদি না থাকার পরেও তিনিই ক্লাসে প্রথম হতেন। ঊর্মিলা পওয়ারের আত্মজীবনীও একই কথা বলে। আমাদের নদিয়ার কল্যাণী ঠাকুরকে তো ক্লাসের বাইরে বসতে হত, যদিও প্রতি ক্লাসে তিনিও প্রথম হতেন। অনেক বেদনার থেকে তিনি লেখেন ‘আমি কেন চাঁড়াল লিখি’ (২০১৬)। কোনও প্রকাশক না পেয়ে বইটি তিনি নিজেই প্রকাশ করেন এবং সত্যিই তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘নীড়’ পত্রিকার উদ্বাস্তু সংখ্যা (২০০৩) থেকে নিজের নামের সঙ্গে চাঁড়াল (চণ্ডাল/চামার) লিখতে শুরু করেন। কল্যাণী আত্মজীবনীতে লেখেন— “সমাজে শক্তিশালী ও সম্মাননীয় হয়ে উঠতে না পারলে তোমার সম্প্রদায়, সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা কেউ শুনবে না, মর্যাদা দেবে না।” আত্মজীবনীতে আরও লেখেন চাকরি পাওয়ার পরেও তাঁকে অফিসে চেয়ারে নয়, বেঞ্চে বসতে দেওয়া হত। আরেক দলিত লেখক সুজাথা গিধলা লেখেন— “জন্মসূত্রে যদি কেউ একজন দলিত হয় তাহলে দলিত হয়েই সে মারা যায়।” এ কথার হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি প্রকাশিত মাদ্রাজ হাইকোর্টের একটি রায় থেকে— “CONVERSION DOES NOT CHANGE CASTE.” Justice S. M. Subramanium আরও বলেন— “A Dalit cannot claim his marriage to another dalit as an intercaste marriage.” (TOI KOLKATA VERSION Date: November 26 2021) এখানে মীনা কান্ডাস্বামীর একটি শ্লেষাত্মক কবিতা পড়া যেতে পারে।

শূদ্রকে ব্রাহ্মণে পরিণত করার গাণিতিক পদ্ধতি
মীনা কান্ডাস্বামী

শুরু:

পদক্ষেপ ১: একটি সুন্দরী শূদ্র মেয়ে নাও।
পদক্ষেপ ২: তাকে একজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিয়ে দাও।
পদক্ষেপ ৩: সে ব্রাহ্মণের ঔরসে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিক।
পদক্ষেপ ৪: ওই সন্তানটিকে একজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিয়ে দাও।
পদক্ষেপ ৫: পদক্ষেপ ৩ ও ৪-এর পুনরাবৃত্তি ঘটাও ছয়বার।
পদক্ষেপ ৬: শেষ ফলাফল প্রকাশ করুন। নিঃসন্দেহে ইহা একজন ব্রাহ্মণ ।

সমাপ্ত।।

সুকীর্থারানির আরেকটি কবিতার উল্লেখ এ প্রসঙ্গে না করলেই নয়, যেখানে তাঁর বলিষ্ঠ মানসিকতার উত্তরণ অত্যন্ত পরিষ্কার।

মাংসের একটি হালকা গন্ধ
(A Faint Smell of Meat)

তাদের মনের মধ্যে—
আমি যেন হালকা ভাবে মাংসের গন্ধ পাই।
আমার বাড়ির সর্বত্র ছাল মাংস ছাড়ানো
হাড় ঝোলে।
আমার বাড়ির রাস্তায়
বাধাহীনভাবে যুবকরা যাতায়াত করে
উচ্চস্বরে নারকেলমালায়
চামড়া লাগিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে।
এ সবই হয় শহর থেকে অনে—ক দূ—রে এক প্রান্তে।
কিন্তু আমি, হ্যাঁ আমি
তাদের আশ্বাস দিই—
তথাপি, আমরা রয়েছি
এক্কেবারে পুরোভাগে।

সুকীর্থারানির বাবা রানিপেটের EID PARRY COMPANY-তে শ্রমিকের কাজ করতেন। সুকীর্থারানি ছয় সন্তানের মধ্যে ছিলেন পঞ্চম। বাবা ছিলেন হিন্দু, মা খ্রিস্টান। কিন্তু তাঁরা খ্রিস্টান ধর্মমতেই বিশ্বাস করতেন। একটি অপ্রকাশিত প্রবন্ধে ‘NAANUM EN EZUTHUM’ (যার অর্থ আমার লেখা ও আমি) তিনি লেখেন অপরিমিত স্বাধীনতায় তিনি বড় হয়ে ওঠেন একেবার টমবয়ের মতো। সাইকেল চড়া, গাছে চড়া, পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, চোখ লাল হয়ে না ওঠা পর্যন্ত পুকুরে সাঁতার কাটা চলতেই থাকে যতদিন না বয়ঃসন্ধি আসে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একজন শিক্ষকের উৎসাহে ও মাধ্যমে তিনি ঐশ্বর্যময় তামিল সাহিত্য সম্পর্কে জানতে পারেন। কিন্তু গুরুত্বসহকারে লেখালিখিতে আগ্রহী হন উচ্চশিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের কোর্স শেষ করার পর। বস্তুত লিঙ্গবৈষম্যের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার নিজস্ব প্রশ্ন ও উত্তরগুলির জন্যে তিনি একটি উপযুক্ত ভাষা ও প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিলেন। এই আলোচনার ফাঁকে তাঁর একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক।

শিশু ভাষা
(Infant Language)

আমার একটি নিজস্ব ভাষার প্রয়োজন।
মাতৃজঠরে এখনও ভাসছি—
যে ভাষায় কেউ এখনও অবধি কথা বলেনি
চিহ্ন এবং অঙ্গভঙ্গি দিয়েও যা বোঝানো যায় না,
এই ভাষা হবে খোলামেলা এবং সমীহযোগ্য
যা আমার ছেঁড়া অন্তর্বাসের মধ্যে লুকোনো নয়।
এর মধ্যে থাকবে অযুত শব্দ
যা কখনও পাশ দিয়ে যাওয়া তোমার পিছনে
ছুরি মারবে না।
আমি বেশ স্মরণ করতে পারছি শেষ রাতের স্বপ্নগুলো
এসো, তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই—
অভিযোগ হিসেবে নয়
এর অর্থ আকাশের মতো উদার ও বিস্তৃত
এর নম্র শব্দগুলো কখনও আঘাত দেবে না
জিভের নমনীয় পৃষ্ঠকে।
সেই অনন্যভাষার চাবিকাঠি
সমস্ত দুঃখের টানবে ইতি
আর গর্বিত করবে তোমাকে।
তুমি আমার নিজস্ব অক্ষরগুলি পড়বে ও ভয় পাবে।
তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করবে কথার পৃষ্ঠে কথা দিয়ে,
যে কথাগুলো তেতো টক আর পচা;
আর আমাকে ফেরত নিয়ে যাবে আমার
অস্বচ্ছ ভাঙা কাচের কাছে।

এবং আমি সেটাও নগ্নভাষায় লিখে রাখব
লিখে রাখব—
চটচটে আঠালো রক্তমাখা
একটি নাদান শিশুভাষায়।

শিশুজন্মের সময় তার সারা গা রক্তে মাখামাখি থাকে যা এখানে একটি নতুন নিজস্ব ভাষার সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে যে নবীন ভাষা অনেক যন্ত্রণা মেখে উঠে আসছে।
সুকীর্থারানি এরপর থেকে বিভিন্ন সাহিত্য উৎসব, বিতর্কসভা ও প্রতিযোগিতায় যোগদান করতে থাকেন। তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিনগুলিতে প্রকাশিত কবিতা পড়তে থাকেন। কবিতা লিখতে শুরু করেন প্রথাগত পদ্ধতিতে অর্থাৎ অনুপ্রাস ও পঙ্‌ক্তির শেষে ধ্বনিসাদৃশ্য বজায় রেখে রেখে। তাঁর লেখায় পরিবর্তন আসে যখন তাঁর এক বন্ধু তাঁকে পরিচয় করান বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে। এরপর তিনি আরও সাহিত্যসভায় যোগদান, কবি সমালোচকদের সঙ্গে সাক্ষাত-সহ উদ্দীপিত হওয়ার মতো বইপত্র পড়তে থাকেন। কমলা দাস ও তসলিমা নাসরিনের লেখা তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করল। আস্তে আস্তে কবিতা সম্পর্কে তাঁর বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ হতে থাকল। তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা তিনি খুব সরলতার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন এইভাবে— “কবিতার বোধ যত আমার মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে, যে সব প্রশ্ন ও সন্দেহ আমাকে এতাবৎকাল রক্তাক্ত করে চলেছিল, অতীতের সমালোচনাগুলি আমার মনের পৃষ্ঠতলে যত উঠে আসতে লাগল সেগুলি কবিতার রূপধারণ করতে লাগল।”
সুকীর্থারানির কবিতা যত নারীবাদের দিকে ঝুঁকতে লাগল এবং বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হতে লাগল, ততই তাঁর পরিবারের দিক থেকে অসম্মতির প্রকাশ ঘটতে লাগল। মা-বাবার দিক থেকে এইসব কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে জনসভায় যোগদানেও আপত্তি দেখা দেওয়ায় তাঁকে মাঝে মধ্যে মিথ্যের আশ্রয়ও নিতে হত। ২০০২ সালে তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন KAIPPATRI EN KANAVU KEL (আমাকে ধরে থাকো আর শোনো আমার স্বপ্নের কথা) প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সুকীর্থারানির নাম অন্যান্য মহিলা কবির সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুরু করে। অশ্লীলতার দায়ও এসে পড়ে এবং অচিরেই তিনি পরিবারের সমর্থন হারান। তিনি বলছেন, “আমি বুঝতে পারলাম একটি মেয়ের শরীর কীভাবে পুরুষের সম্পত্তি হয়ে ওঠে, আমি বুঝলাম আমার প্রথম কাজই হল এর নিরসন, তাই আমার কবিতা শরীরের রাজনীতিকে প্রাধান্য দিল।”
এবার দেখা যাক শরীর নিয়ে উনি কী লেখেন।

আমার শরীর
(My Body)

গুল্মে ঘেরা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে এক নদী বয়ে চলেছে।
এর ধারে ধারে গাছের ডালগুলি ঝুঁকে রয়েছে।
মাঝে মাঝে জলকেও ছুঁয়ে রয়েছে।
আদার মতো স্বাদের ফলগুলির
সূক্ষ্ম চামড়া এবং বীজগুলি ঝরে পড়ছে।
পাহাড়ের গভীর গহ্বর থেকে উপচে পড়ছে জল
খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে আসছে।
একটি বাঘ তার হত্যা সম্পূর্ণ করার পর
তার রক্তমাখা মুখ
দ্রুত বয়ে যাওয়া স্রোতে ধুয়ে নিচ্ছে ।
সেই নেমে আসা স্রোতে লালরঙা ছাই ছড়িয়ে পড়ছে যেন তার মুখের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ।
একটি ঘূর্ণি ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরছে ।
পৃথিবীকে আন্দোলিত করছে।
দিনের উত্তাপ রাতের শীতলতায় মিশে যাচ্ছে ।
সব শেষে প্রকৃতি হয়ে উঠছে আমার শরীর
যা স্থিরভাবে শায়িত।

চমৎকার একটি কবিতা যা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। চমৎকার একটি বর্ণনার মাধ্যমে একটি সহনশীল নারী তথা প্রকৃতির শরীরের উপর শোষণের আগ্রাসী রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই বাঘ, এই ঘূর্ণি এই স্বতঃ নেমে আসা যৌবনের জলোচ্ছ্বাস— এ সবই আমাদের চেনা, সুকীর্থারানি আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন প্রকৃতি এবং নারী কীভাবে শোষণের সামনে মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে। হঠানো হয়েছে আরেকটি কবিতা KAIMAARU (ঋণ বা Debt) এই কবিতায় দরিদ্র দলিত পথকুড়ানির (scavenger)অসহায়তা, বাড়ির পিছনের ছাই ও আবর্জনার স্তুপ থেকে লোহালক্কড় কুড়িয়ে মাথায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা আছে। হলুদ রঙা ঘামের সঙ্গে তা চুঁইয়ে নামছে সারা গায়ে। কে পরিষ্কার করবে তার এই নোংরা শরীর?

ঋণ
(Debt)

এক টুকরো আড়াল,
ঝুড়ির নীচেটা বেঁধে নিয়ে
মহিলাটি বেরিয়ে পড়ে।

একটা বাড়ির পিছনে এসে দাঁড়াল সে।
বড় বাড়ি, অনেক লোকের বাস।
সে এগিয়ে যায়—
তার চোখ পড়ে ছাইগাদায় একটা
চৌকো লোহার পাতের দিকে।
একটা পেরেক থেকে ঝুলছে।
এক হাত দিয়ে ওটাকে তুলে ধরে
সে তার মধ্যে থেকে একমুঠো ছাই তুলে ফেলে দেয়।

তারপর—
অমসৃণ গর্তটির ভেতর ঘষটে ঘষটে হাত চালিয়ে
সে খুঁটে খুঁটে নোংরা হাতড়ায় আর হাতড়ায়
বাঁ দিক থেকে ডানদিকে
আর কাত করা ঝুড়িতে ভরে ফ্যালে।

তারপর—
সরল ও স্বাভাবিকভাবে
নিজের পথে চলে যায়।

আমি তার জন্যে কী বা করতে পারি
অন্তত একবারের জন্যেও
তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা ছাড়া?

বর্তমানে সুকীর্থারানির প্রকাশিত কবিতার সংকলনগুলি:
KAIPPATRI ENKANAVU KEL (আমাকে ধরে রাখো, আমার স্বপ্নগুলো শোনো/ Hold me and hear my dreams) ২০০২ সালে প্রকাশিত। IRAVU MIRUGAM (রাতের পশু/ Night beast) প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে এবং তাঁর কবিতা অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়। AVALAI MOZHIPEYARTTHAL (সেই স্ত্রীলোককে অনুবাদ করছি/ Translating her) প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে। TIINDAPADAADA MUTTHAM (অস্পৃশ্য চুম্বন/ UNTOUCHABLE KISS) প্রকাশিত ২০১০ এবং KAMATHTHIPPOO (ভালোবাসার ফুল/ LOVE’S FLOWER) প্রকাশিত হয় তারপরে।
দলিত হিসেবে তাঁর সচেতনতা এবং সারা পৃথিবীকে একজন দলিত ও নারীবাদীর চোখে দেখা আর কবিতায় তার সংবেদনশীল ও বলিষ্ঠ প্রকাশ তাঁকে অন্য তামিল মহিলা কবিদের থেকে আলাদা করেছে। বেশ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
শেষ করব সুকীর্থারানির অসম্ভবসুন্দর একটি কবিতা দিয়ে।

প্রকৃতির ঝর্নাধারা
(Nature’s Fountainhead)

তোমাকে বলছি, আমাকে জ্যান্ত কবর দাও
আমি একটা সবুজঘাসের মাঠে পরিণত হব
আর একটা উর্বরজমির মতো বিছিয়ে থাকব।

তুমি আমাকে আগুনে জ্বালিয়ে দিতে পারো
আমি একটা আগুনপাখি হয়ে যাব
আর মুক্ত বিস্তীর্ণ পরিসরে উড়ে বেড়াব।
তুমি তোমার যাদুদণ্ড নাড়িয়ে
আমাকে জিনির মতো
একটা বোতলে ভরে ফেলতে পারো
আমি সোজা হয়ে আকাশের দিকে
পারদের মতো উবে যাব।

তুমি আমাকে বাতাসে মিশিয়ে দিতে পারো
যেমন জল জলের মধ্যে মিশে যায়
বিভিন্ন দিক থেকে এসে।
আমি তীব্র ফুৎকারের মতো উদয় হব।

তুমি আমাকে ছবির মতো ফ্রেমে বাঁধিয়ে
দেওয়ালে ঝোলাতে পারো
হঠাৎ আসা নদীর প্লাবনের মতো
আমি উপচে নেমে আসব তোমাকে পেরিয়ে।

আমি হয়ে উঠব
পৃথিবী
আগুন
আকাশ
বাতাস
জল
যত তুমি আমাকে বাঁধবে, তত আমি বাঁধ ভেঙে
বেরিয়ে আসব
প্রাকৃতিক ঝর্নাধারার মতো।।

 

 

ব্যবহৃত তথ্যসূত্র—

১) WILD WORDS
Four Tamil poets: Translated by
LAKHMI HOLMSTROM.
HARPER PERENNIAL, 2015
২) আধুনিক দলিত মহিলাদের আত্মজীবনী ও বিবর্তন: কিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়: অনুষ্টুপ গ্রীষ্ম বর্ষা ও প্রাক শারদ যুগ্ম সংখ্যা ২০২০
৩) MEENA KANDASWAMY POEMS
Poemhunter.com — The world’s poetry archive 2015.

ব্যবহৃত সমস্ত কবিতা ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক।

 

নিবন্ধটি কবিসম্মেলন পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত। সংখ্যাটি পাওয়া যাচ্ছে এখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.